ক) ভাইরাসজনিত রোগ
১) হোয়াইট স্পট বা চায়না ভাইরাস রোগ (White spot syndrome baculovirus-WSBV)
- চিংড়ি পাড়ের কাছে জড়ো হয়।
- গায়ে, মাথায়, খোলসে সাদা সাদা স্পট দেখা যায়।
- নীল বা লালচে রং ধারণ করে।
- খোলসের নিচে সাদা ক্যালসিয়াম লবণ জমা হয়ে স্পষ্ট হয়।
- সাধারণত ঘেরের সব চিংড়ি ৩-৭ দিনের মধ্যে মারা যায়।
চিকিৎসা
- এ রোগের কোন চিকিৎসা নেই।
- এই রোগে আক্রমণের ফলে ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিয়মিত খামার পরিদর্শন করতে হবে।
- রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ার সাথে সাথে চিংড়ি আহরণ শুরু করতে হবে।
২) সংক্রামক হাইপোডার্মাল এবং হেমাটোপয়েটিক নেক্রোসিস (Infectious hypodermal and hematopoietic necrosis -IHHN)
লক্ষণ
- সংক্রমিত চিংড়ি কম খাদ্য গ্রহণ করে, নরখাদকতা দেখায়।
- পেটের পেশী অস্বচ্ছ হয়।
- কিউটিকুলার রুক্ষতা দেখা যায়।
- কিউটিকুলার বিকৃতি।
- বিকৃত রোস্ট্রাম একপাশে বৃদ্ধি।
- জুভেনাইল ও সাব অ্যাডাল্টদের অনিয়মিত বৃদ্ধি।
চিকিৎসা
- IHHN-এর জন্যে কোনো কার্যকরী টিকা দেয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়নি।
- পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে হবে।
- সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব ।
৩) মনোডন ব্যাকুলোভাইরাস (Monodon Baculovirus MBV)
লক্ষণ
- তীব্র MBV, হেপাটোপ্যানক্রিয়েটিক টিউবুল এবং মিউপাট এপিথেলিয়ার ক্ষতি ঘটায়।
- অঙ্গের কর্মহীনতা এবং সেকেন্ডারী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে।
- জুভেনাইল চিংড়ির উচ্চ মৃত্যু ঘটে।
- যকৃত, অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি ও খাদ্যনালীতে এ ভাইরাস সংক্রমণ ঘটায়।
চিকিৎসা
- কোন পরিচিত চিকিৎসা নেই।
- ব্রুড ষ্টকের মল থেকে ডিম ও নগ্নি (Nauplii) এর দূষণ এড়াতে হবে।
- ভাইরাস বহনকারী পোস্ট লার্ভা খামারে ব্যবহার করা যাবে না।
- সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে এ রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব।
৪) মস্তক হলুদ রোপ
লক্ষণ
- যকৃত ও অগ্নাশয় গ্রন্থি ফ্যাকাশে হওয়া।
- প্রথম দিকে বেশি খাবার খায় এবং পরে হঠাৎ খাবার বন্ধ করে দেয়।
- সেফালোথোরাক্সের রং হলুদ হবে, শরীরের রং ব্লিচ করবে।
- পুকুরের কিনারায় জমা হতে দেখা যায়।
চিকিৎসা
- সুষ্ঠু খামার ব্যবস্থাপনার ফলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
- পুকুরের তলদেশ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ব্লিচিং পাউডার / চুন দিয়ে ভালো করে মাটি শোধন করে নিতে হবে।
খ) ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ
১) নেক্রোটাইজিং হেপাটোপ্যানক্রিয়াটাইটিস (Necrotising hepatopancreatitis (NHP)
লক্ষণ
- চিংড়ির অলসতা দেখা যায় এবং স্বাভাবিক চলাফেরা কমে যায়।
- হেপাটোপ্যানক্রিয়াস ফ্যাকাশে এবং ক্ষীণ হয়ে যায়।
- খাদ্য গ্রহণে অনীহা এবং পরিপাকনালী খাদ্য শূন্য থাকে ।
- চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।
- স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যায়।
চিকিৎসা
- এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই।
- খামারে যাতে এই রোগ আসতে না পারে তার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- পিসিআর পরীক্ষা করা পোষ্ট লার্ভা মজুদ করতে হবে।
- পোষ্ট লার্ভা এর মজুদ ঘনত্ব ঠিক রাখতে হবে।
- খামারের জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে।
২) কালো ফোটা রোগ (Black spot disease)
লক্ষণ
- শরীরে বাদামী থেকে কালো রঙের ক্ষত দেখা যায়।
- কিউটিকল, এপেন্ডেজ ও ফুলকায় এক বা একাধিক ক্ষতস্থান দেখা যায়।
- ছোট ক্ষতস্থান দিয়ে শুরু হলেও পরে দ্রুত বড় হয়ে যায়।
- খোলস সহজে ভেঙ্গে যায়।
চিকিৎসা
- নাইট্রেট এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রোবায়োটিক দিতে হবে।
- আক্রান্ত চিংড়িকে ২০ পিপিএম মাত্রায় ফরমালিন অথবা ০.৩ পিপিএম মাত্রায় মেলাকাইট গ্রিন এ ১২ ঘন্টা চুবিয়ে রাখতে হবে।
- পানি পরিবর্তনের মাধ্যমে জৈব পদার্থের পরিমাণ হ্রাস করতে হবে।
৩) লেজ পঁচা রোগ (Tail rot disease)
- লেজের কিনারা বিবর্ণ হয়ে যায়।
- চিংড়ি চলাফেরা বন্ধ করে দেয়।
- লেজের মাংসপেশীতে ক্ষয় ও পচন হয়।
- চিংড়ির লেজ কালো বর্ণ ধারণ করে এবং নিচের দিকে হেলে পড়ে।
চিকিৎসা
- এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। যেমন, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন প্রতি কেজিতে ২-৩ গ্রাম, ১০-১২ দিন।
- ১৫ পিপিএম মাত্রায় ফরমালিন বা ০.৩ পিপিএম মাত্রায় মেলাকাইট গ্রিন দ্রবণের মধ্যে চিংড়িকে ১০-১২ ঘন্টা রাখতে হবে।
৪) ব্যাকটিরিয়াল সেপ্টিসেমিয়া (Bacterial septicemia)
লক্ষণ
- সাঁতারে অস্বাভাবিকতা দৃষ্টিগোচর হয়।
- ক্রোমাটোফোরের প্রসারণ ও প্লিওপোডগুলোতে লাল রঙের পরিবর্তন ঘটে।
চিকিৎসা
- পানি পরিবর্তনের মাধ্যমে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমিয়ে এ রোগের প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
- এন্টিবায়োটিকের সাথে উচ্চ মাত্রায় আমিষযুক্ত খাদ্য খাওয়ানোর মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে
৫) কালো দাগ রোগ (Black spot / shell disease)
লক্ষণ
- চিংড়ি খোলস, লেজ ও ফুলকায় কালো দাগ হয়।
- খোলসের গায়ে ছিদ্র হয়।
- পরবর্তীতে ফাংগাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চিংড়ি মারা যায়।
- খোলসের নীচে চ্যাপ্টা কালো দাগ দেখা যায়।
- লেজের মাংসপেশীতে আঁচড়ের মত দাগ দেখা যায়।
চিকিৎসা
- প্রতি কেজি খাদ্যে ২-৩ গ্রাম হারে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ৭-১০ দিন ধরে প্রয়োগ করতে হবে।
- চাষকালীন সময়ে নিয়মিত পানি পরিবর্তনসহ সুষম খাদ্য ও সার প্রয়োগ করতে হবে।
- পুকুরের কাদা তুলে চুন/ সার দিয়ে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
গ) পরজীবীজনিত রোগ
১) ইপিকম্মেন্সাল রোগ (Epicommensal disease)
লক্ষণ
- দেহ মাটি জাতীয় পদার্থ দিয়ে আবৃত থাকে।
- দেখতে বিবর্ণ দেখায়।
- শ্বসন প্রক্রিয়া, চলাফেরা ও খোলস পরিবর্তনে বাধার সৃষ্টি হয়।
চিকিৎসা
- খামারের পানি নিয়মিত পরিবর্তন করতে হবে।
- ফরমালিন (১৫-৫০ পিপিএম) ও মেলাকাইট গ্রিন (০.৫-১.০ পিপিএম) দ্রবণে চিংড়িকে রাখতে হবে।
- চুন প্রয়োগ করতে হবে
২) ইন্টারোসাইটোজোন হেপাটোপেনাই (Enterocytozoon hepatopenai, EHP)
লক্ষণ
- মৃত্যু ঘটায় না কিন্তু চিংড়ির বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে সীমিত করে।
- গ্যাসট্রোইনটেষ্টিনাল ট্রাক্ট এ সাদা বর্ণ দেখা যায়।
- পুকুরের পানিতে সাদা রংয়ের মল ভেসে থাকে।
চিকিৎসা
- খামারের জৈব নিরাপত্তা রক্ষা করতে হবে (লাইফ ফিডের জীবাণুমুক্তকরণ)।
- পুঞ্জিভূত জৈব পদার্থের অপসারণ করতে হবে।
- সুনির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক নেই।
ঘ) ছত্রাকঘটিত রোগ
১) ফুলকা পঁচা রোগ (Gill not disease)
লক্ষণ
- ফুলকায় ময়লা জমে, শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায় এবং দুর্গন্ধ হয়।
- দেহের বর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
- ফুলকা পঁচে ও ফুলে যায়।
- ফুলকায় রক্তক্ষরণ হয়।
চিকিৎসা
- প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে পাথুরে চুন তিন মাস পরপর দিতে হবে।
- আক্রান্ত চিংড়িকে ০.৫-০.৮ পিপিএম মাত্রার মেলাকাইট গ্রিন দ্রবণে রাখতে হবে।
- ৫০ পিপিএম ফরমালিন দ্রবণে ১ ঘন্টার জন্য ডুবিয়ে রাখতে হবে।
২) ছত্রাক রোগ (Fungal disease)
লক্ষণ
- চিংড়ির ফুলকায় ফোঁটা ফোঁটা দাগ দেখা যায়। এতে খোলস নষ্ট হয়ে যায়।
- হ্যাচারিতে পোস্ট লার্ভা বেশি আক্রান্ত হয়।
- ফুলকার ল্যামিলা নষ্ট হয়ে যায়।
- শ্বাস-প্রশ্বাস এ ব্যাঘাত ঘটে।
চিকিৎসা
- ঘেরের তলা ভালোভাবে শুকিয়ে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- আক্রান্ত চিংড়িকে আলাদা করতে হবে।
- অক্সালিক এসিড দ্রবণে ০.১-০.৫ পিপিএম মাত্রায় ৩-৫ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
৩) কালো ফুলকা রোগ (Black gill disease)
- ফুলকায় কালো দাগ ও পচন দেখা যায়।
- শ্বাস-প্রশ্বাস এ ব্যাঘাত ঘটে।
- খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা যায়।
- বড় চিংড়িতে বেশি হয় এবং বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।
চিকিৎসা
- হাইড্রোজেন সালফাইড ও অন্যান্য জৈব পদার্থের জন্য ঘেরের তলায় যে গ্যাস হয় তা আচড়িয়ে বা হররা টেনে মুক্ত করতে হবে।
- পানি পরিবর্তন করতে হবে।
- প্রতি কেজি খাদ্যে ২০০০ মিলিগ্রাম হারে এসকরবিক এসিড মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
৪) ফুসেরিয়াম রোগ (Fusarium sp.)
লক্ষণ
- মাইসেলিয়াল বৃদ্ধির কারণে লোকোমোটরি অসুবিধা হয়।
- ফুলকার ফাউলিং হয়।
- ফুলকার আশেপাশে ক্ষত দেখা যায়।
- পেরিওপোড, ইউরোপোড ও লেজে লালচে বর্ণ দেখা যায়।
চিকিৎসা
- ঘেরের তলা পরিষ্কার রাখতে হবে এবং নিয়মিত পানি পরিবর্তন করতে হবে।
- মিথাইল ব্লু ০.১-১.১ পিপিএম মিশ্রিত দ্রবণে ৫-১০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে।
- Gentian violet দ্রবণ ১-২ পিপিএম মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
ঙ) অপুষ্টিজনিত রোগ
১) খোসা নরম রোগ (Soft shell disease)
লক্ষণ
- ক্যালসিয়ামের অভাবে এ রোগ হয়।
- খোলস বদলানোর ২৪ ঘন্টা পরেও শক্ত হয় না ।
- বৃদ্ধি কম হয় এবং মাংসপেশীতে কালচে বর্ণ ধারণ করে।
- ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সেকেন্ডারী ইনফেকশন হতে পারে।
চিকিৎসা
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রতি শতাংশ পানিতে ১ কেজি পরিমাণ পাথুরে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- প্রতি কেজি খাদ্যে ভিটামিন সি ২০০০ মিলিগ্রাম হারে ১ মাস প্রয়োগ করতে হবে।
২) দেহ খিচুনি রোগ (Body cramp disease)
লক্ষণ
- কোয়াগুলোটিভ নেক্রোসিস দেখা যায়।
- চিংড়ির মাংশপেশী সংকুচিত হয়।
- দৈহিক বৃদ্ধি কমে যায়।
- অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও পুষ্টির অভাবে এ রোগ হয়।
চিকিৎসা
- তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
- খাবারের সাথে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সোডিয়াম সরবরাহ করতে হবে।
- দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৫ পিপিএম রাখতে হবে।
চ) বিবিধ রোগ
১) চিংড়ির গায়ে শেওলাজনিত সমস্যা (Extrenal fouling of shrimp)
লক্ষণ
- গায়ে শেওলা জমে থাকে।
- শেওলা জমায় খোলস বদলাতে পারে না।
- দৈহিক বৃদ্ধি কম হয় এবং আস্তে আস্তে মারা যায়।
- চিংড়ির দেহ ও খোলস নীল বর্ণ ধারণ করে ।
চিকিৎসা
- পানির গভীরতা বাড়াতে হবে।
- পোস্ট লার্ভার মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে
- চুন/সার ও খাদ্য সীমিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
২) বুদবুদ রোগ (Gas bubble disease)
লক্ষণ
- ফুলকা ও চোখের বলে ছোট ছোট গ্যাসের বুদবুদ দেখা যায়।
- গ্যাসের কারণে ভাসমান সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত উল্টো সাঁতার কাটে।
- রক্ত নালী ও অঙ্গসমূহের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়।
চিকিৎসা
- আক্রান্ত চিংড়িকে উচ্চ চাপের গভীর জলে (কমপক্ষে ১মিটার) রাখতে হবে।
- পুকুরের তলদেশ আন্দোলনের মাধ্যমে অথবা হররা টেনে গ্যাস মুক্ত করতে হবে।